Wednesday, December 12, 2012

প্রথম জামাই


মানিকের বয়স তখন কতইবা হবে, খুব বেশী হলে বার তের। কিন্তু বয়সের তুলনায় শারিরীক বৃদ্ধি ঘটলেও মানসিক পূর্ণতা আসেনি। তারও কারণ আছে। দু'বোনের পর ওর আগমনে সকলের মধ্যে একটি খুশির জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। ফলে আদরের মাত্রাও সে হারে বেশী পেয়েছে। বড় দু'বোন আর তাদের বান্ধবীদের ঘিরেই ওর জগৎ গড়ে উঠে। এজন্য মানসিক ভাবে যতটা পরিপক্কতা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। মেয়েদের সাথে থাকতে থাকতে স্বভাবটাও অনেকটা মেয়েলি হয়ে যায়।&মানিকদের বাড়ীটি ছিল গ্রামের মধ্যে একটি অসাধারণ বাড়ী। সাধারণতঃ গ্রামের মেয়েরা একটু বড় হলেই তাদের বাড়ীর বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সে ক্ষেত্রে মানিকদের বাড়ীটি ছিল মেয়েদের একটি মিলন মেলার স্থান। প্রায় প্রতি দিনই বিকেল হলেই ওদের বাড়ীর বড় উঠোনটাতে ভর্তি হয়ে যেত পাড়ার মেয়েরা। শুরু হতো বিভিন্ন ধরনের খেলা-ধূলা। মানিক ছিল ওদের খেলার মধ্যমনি। সকলের মধ্যে পরীই ছিল মানিকের একান্ত অন্তরঙ্গ সাথী। বয়সে তিন চার বছর বড় হলেও কেমন করে যেন ওর সাথেই জুটি বেধে যায় মানিকের। এ নিয়ে সব মেয়েদের মধ্যে বেশ কানাঘুষা ও রেশারেশি হলেও কারো কিছুই বলার ছিল না। কারণ মানিক'কে রাগিয়ে ওদের বাড়ীতে খেলা-ধুলা করা সম্ভব ছিল না। পরী ছিল মানিকের মেঝ আপার ঘনিষ্ট বান্ধবী। যাকে বলে এক মন এক প্রাণ। পরীর রূপের বর্ণনা না দেয়াই ভাল। কারণ পরীকে সবাই কল্পনাতে দেখতেই অভ্যস্থ। কিন্তু সত্যিকারভাবে যদি কেউ বাস্তবে পরীকে দেখতে চায় তবে মানিকের পরী আপাকে দেখতে হবে। পরীর গায়ের রং ছিল কবির ভাষায় দুধে আলতায়। পাখির নীড়ের মত দুটি চোখ, কেশধাম চিকচিকে কালো রেশমের মত মশৃণ আর লাম্বায় নিতম্ব পেরিয়ে আরও নীচে পড়তো। পরী হাসলে যেন মুক্ত ঝরতো। পরীকে মানিক কখনও কাঁদতে দেখেনি। হাসলে ওর দু'ঠোটের ফাঁকে ধবধবে সাদা দন্তরাশি বলে দিত ওর মনের উচ্ছলাতার কথা। এই পরীকে নিয়েই আজকের কাহিনী। অনেক ধরণের খেলার মধ্যে ওরা বেশী খেলতো লুকোচুরি আর জামাই বৌ। আগেই বলেছি মানিকের সাথি ছিল পরী। তাই যখনই জামাই বৌ খেলা হতো তখন অবধারিতভাবেই বৌ সাজতো পরী। ওরা বড়দের অনুকরণ করে ঘর সংসার করতো। বাজার করা, নদীতে গোসল করা, ভাত বেড়ে পাশে বসে বাতাস করা এবং খাওয়ার পর পান হাতে পাশে এসে দাড়ানো, সবই বড়দের মত করে ওরা খেলতো। এমনি এক দিনে মানিক খাবার শেষ করে যখন বসে আছে পরী তখন পান নিয়ে এসে পাশে দাড়ায়। মানিকের কি মনে হয় হঠাৎ পরীকে বলে -'বৌ তুমিতো কখনও রানু ভাবীর মত আমাকে আদর করনা, তুমি পচা বৌ।' ( রানু ভাবী মানিকের চাচাতো ভাইয়ের নতুন বিয়ে করা বৌ। শহরের মেয়ে তাই রানু ভাবীকে ওদের বেশী পছন্দ। কি সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে শাড়ী পরে সাড়া বাড়ী ঘুরে বেড়ায় আর সুযোগ পেলেই ঘরে ঢুকে ভাইয়ের সাথে দুষ্টমি করে, যা ওরা ব্যাড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতো )। কথাটি শুনে পরীর ফরসা মুখটি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। চারিদিকে তাকিয়ে মানিকের কাছ ঘেষে ওর মাথাটি বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে- 'আমাদের কি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়েছে যে সত্যি সত্যি আদর করবো?মানিক পরীর বুকের ধুক ধুক আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু বুঝতে পারেনা পরীর মন ধুক ধুক করে কি বলতে চায়। এভাবেই চলছিল সময়। ঐ সময়ে মানিকদের গ্রামের অবিবাহিত মেয়েরা সাধারণতঃ 'বারা' পরতো। 'বারা' হচ্ছে শেলাই ছাড়া লুঙ্গির মত সুন্দর একটুকরো কাপড়। বার্মিজ ও উপজাতীয় মেয়েরা পরে। গায়ে ব্লাউজ আর একটি বড় ওরনা। এতে ওদের বেশ ভালই লাগতো। কিন্তু রানু ভাবীর শাড়ী পরা ছিল মানিকের খুব পছন্দ। তাই একদিন সুযোগ বুঝে পরীকে বলে- 'পরী আপা তুমি রানু ভাবীর মত শাড়ী পড়না কেন? শাড়ী পড়লে তোমাকে খুব সুন্দর লাগবে। পরী মানিকের দিকে দুষ্টমি ভরা দু'চোখ মেলে বলে- 'তুমিতো আমার জামাই। তুমি যখন আমাকে শাড়ী কিনে দেবে তখন পড়বো।'পরীর কথা শুনে মানিকের ছোট্ট মনে একটি আশার জন্ম হয়। মানিক ভাবতে থাকে কিভাবে পরীকে একটি সুন্দর শাড়ী কিনে দেয়া যায়। একাকি মনে মনে আল্লাহকে ডেকে বলে যেন একটি শাড়ী কিনে দেয়ার মত টাকা ওর হয়। আর একদিনের ঘটনা- ওরা সেদিন লুকোচুরি খেলছিল। মানিক ওদরে লাকড়ী রাখার ঘরের একটি বড় ড্রামের পাশে লুকিয়ে ছিল। হঠাৎ দেখে পরী দৌড়ে ঐ ঘরে ঢুকছে। মানিক নিজেকে ভালভাবে লুকাবার চেষ্টা করে। পরী দৌড়ে ঘরে ঢুকে ঠিক মানিকের সামনে দাড়িয়ে ওর 'বারা'টি খুলে ভালকরে টাইট করে পরে নেয়। হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই দেখে মানিক ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মানিকও পরীকে এই অবস্থায় দেখে বোকার মত হেসে বলে-'আমি সব দেখে ফেলেছি'। হঠাৎ করেই পরীর সাদা মুখটি রক্ত গোলাপের মত লজ্জায় লাল হয়ে যায়। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে মানিকের সরলতা বুঝতে পেরে ওর কাছে এসে সলজ্জ কন্ঠে বলে-'তুমিতো আমার জামাই, তাই তুমি দেখলে কিচ্ছু হবে না' আর একটু ঘনিষ্ট হয়ে মানিকের মাথাটি ওর বুকে চেপে ধরে বলে-'এ কথা কাউকে বলবে না কিন্তু। তাহলে ওরা তোমাকে খুব খ্যাপাবে।' মানিক মজা করার জন্য কথাটি বলেছিল। কিন্তু পরীর কথায় বুঝতে পারে এ কথা কাউকে বলা যাবে না। পরীর লজ্জাভরা লাল মুখটি ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে। মানিকের অন্তরের কথা সৃষ্টিকর্তা শুনে ফেললেন। তাই কয়েক দিনের মধ্যেই পরীর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। মানিক ভাবে এটাই সুযোগ। মেঝো আপা পরী আপার বিয়েতে অবশ্যই একটি ভাল উপহার দেবে। মেঝো আপাকে পটিয়ে এই সুযোগে পরীকে একটি সুন্দর শাড়ী উপহার দিতে চায় মানিক। বিয়ের দিন মেঝো আপার সাথে মানিক পরীর বিয়েতে হাজির হয়। ঘরের মেঝেতে পাটি পেড়ে পরীকে ঘিরে সবাই বসে আছে। লাল বেনারশীতে পরীকে আজ সত্যিকারের পরীর মতই মনে হচ্ছে। মানিক ঘরে ঢুকতেই পরী একবার মানিকের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। হঠাৎ বাইরে সবাই চিৎকার করে বলে-জামাই এসেছে, জামাই এসেছে। মূহুর্তের মধ্যে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মানিক পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পরীর মুখে আজ সে হাসি দেখতে পায়না। মানিক ভাবে বিয়ে হলেতো সবাই খুশি হয় তবে পরীর মুখটা ভারী কেন। তবে কি পরী বিয়েতে খুশি না? পরী মানিকের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে- 'তুমি গেলেনা আমার জামাই দেখতে?' হঠাৎ মানিকের অন্তরের মধ্যে ব্যথা করে উঠে, দুচোখে পানিতে ভরে যায়, মানিক বুঝতে না পেরে দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। পরী উঠে ঘরের দরজা বন্ধ করে মানিকে কাছে এসে মানিকের দুহাত মুখ থেকে সরিয়ে বলে- 'ছি! তুমি না পুরুষ মানুষ, পুরুষ মানুষ কি এমনি করে কাঁদে? পরী স্বভাব সুলভ ভাবে মানিকের মাথাটি নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে। মানিক নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না দু'হাত দিয়ে পরীকে জাপটে ধরে। কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর পরী ওকে ছাড়িয়ে দু'হাত দিয়ে ওর মুখটি ধরে দেখতে থাকে। হঠাৎ কি হয়, পরী পাগলের মত মানিকের সারা মুখে চুমু দিতে থাকে। মানিক কিছুই বুঝতে পারে না। কান্না ভুলে অবাক হয়ে পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পরী আবার ওর মাথাটি নিজের বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। পরী নিজেকে সামলে নিয়ে মানিককে খাটে বসিয়ে নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখে লাগা লিপিষ্টিকের দাগগুলো মুছে দিতে দিতে বলে-'তোমার দেয়া শাড়ীটি আমি খুব যত্ন করে রাখবো। কখনও নষ্ট করবো না। তুমিতো আমার প্রথম জামাই'।

No comments:

Post a Comment